কামরুল, স্থানীয় প্রতিনিধি
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে প্রতিবছরের ন্যায় আজ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস (৮ মার্চ) বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালিত হয় । ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরের নারী পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও কর্মপরিবেশের দাবিতে ধর্মঘট ও তাঁদের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯০৯ সালে প্রথমবারের মতো নারী দিবস উদ্যাপনের উদ্যোগ গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “Accelerate Action”। জেন্ডার সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় “অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন”-প্রতিপাদ্যে দিবসটি উদযাপন করছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার”-এর কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সিডো সনদেও বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী দেশ। যার ধারাবাহিকতায় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১৫ প্রণয়ন এবং “নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে জাতীয় পরিকল্পনা ২০১৩-২০২৫” গ্রহণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) এবং বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-২০৪১) নারী-পুরুষ সমতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আবার, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৫ অনুযায়ী নারীদের সমঅধিকার এবং নারী ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ বাংলাদেশ। উল্লিখিত অঙ্গীকারসমূহ থাকা সত্ত্বেও, নারীদের অধিকার ও উন্নয়ন নিশ্চিতে অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে বাংলাদেশ শুধু পিছিয়েই নয়, রীতিমতো উল্টো পথে হাঁটছে।
ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের বৈশ্বিক জেন্ডার বৈষম্য প্রতিবেদন’ (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট) ২০২৪ অনুযায়ী আগের বছরের তুলনায় বিশাল পতন ঘটেছে বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও আগের বছরের তুলনায় ৪০ ধাপ পিছিয়ে ১৪৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে ও সুযোগ সৃষ্টির দিক থেকে এবারের সূচকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে। মাত্র ০.৩১১ স্কোর নিয়ে ১৪৬টি দেশের মধ্যে শেষ অবস্থানে বাংলাদেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়েছে। তা ছাড়া, ছয় বছর আগের তুলনায় বাংলাদেশে নারী-পুরুষের আয় বৈষম্য বেড়ে পাঁচ গুণ হয়েছে। পেশাজীবী ও প্রযুক্তিগত চাকরিতে নারীরা মোট কর্মসংস্থানের মাত্র এক-পঞ্চমাংশের মতো।” অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ পদে নারীর অনুপাত কমেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কৰ্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। বিশেষ করে নারীদের সাহসী উপস্থিতি, সক্রিয় ভূমিকা ও নেতৃত্ব আন্দোলনকে পূর্ণতা দিয়েছে। তবে এই আন্দোলনের পর পরই অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকাকে “প্রথাগতভাবে” অস্বীকার ও উপেক্ষার অভিযোগ ওঠে আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্বদানকারী ও অংশগ্রহণকারী নারীদের কাছ থেকেই। গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখা ও আহত নারীরা এক সংলাপে অভিযোগ করেন, আন্দোলনে সর্বস্তরে নারীদের ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও, আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সংস্কার কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। এমনকি পথেঘাটে নারী হয়রানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ভুক্তভোগীরা। নারীদের সরাসরি চলাচলে বাধা দেওয়া, বাজে মন্তব্য করা, কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশায় আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা নারীরা লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে বিভিন্ন অজুহাতে নিয়মিত হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, যা নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি আর স্বপ্নকে ম্লান করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত “নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪” অনুযায়ী দেশের ৭০ শতাংশ নারী অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ২০২৪ সালে ৪৯ শতাংশ নারীর ওপর এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আরেকটি নির্ভরযোগ্য গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৭২ জন কন্যাশিশু এবং ১১৭ জন নারীসহ ১৮৯ জন বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩০ জন কন্যাশিশুসহ মোট ৪৮ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।১২ অর্থাৎ, বাংলাদেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য দূর করে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৩ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশে নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ৯.৫ শতাংশ বেড়ে ৩৬ শতাংশ হয় এবং ২০২২ সালে তা ৪২.৭ শতাংশে পৌঁছায়। তবে, ৯২ শতাংশ নারী এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যেখানে শোভন কর্মপরিবেশের মানদণ্ড অনুপস্থিত। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, উদ্যোক্তা হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৭ শতাংশ। নারীদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সমান মজুরি, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, শ্রম আইন সংস্কার, এবং নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া, নারীদের চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা প্রতিরোধে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুত যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, যে সব দেশে জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষময়তায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে, সে সব দেশসমূহে দুর্নীতির ব্যাপকতা তুলনামূলকভাবে কম এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। অন্যদিকে, টিআইবি পরিচালিত জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩ এ দেখা যায়, নারী, আদিবাসী এবং প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হওয়ার অর্থ তাদের সীমিত আর্থ-সামাজিক সক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলছে, যার ফলে তারা আরো বেশি প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন। সেবাগ্রহণকারী হিসেবে ৩৪.৬ শতাংশ নারী দুর্নীতির শিকার হন। পুরুষ সেবাগ্রহীতার তুলনায় নারী সেবাগ্রহীতাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।